আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের দলীয় মনোনয়ন না দিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। সে জন্য কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনাও দিয়েছে দলটি। অথচ দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক তপন ঠাকুর।
তিনি গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে বিদ্রোহী হওয়া এই নেতা পৌর নির্বাচনে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। অথচ পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের কোনোভাবেই নৌকার মনোনয়নপত্র পাওয়ার কথা নয়।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এক নেতার ক্ষমতার প্রভাবে দলীয় মনোনয়নপত্র পেয়েছেন তিনি। মাগুরা জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক রানা আমির ওসমান। তিনিও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধরনা দিয়ে পৌর নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। অথচ এই দুই নেতাকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে কেন্দ্রের কাছে লিখিত চিঠি দিয়েছিলেন মাগুরা পৌর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
কেন্দ্রে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ্য করা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশক্রমে বিগত দিনে যারা নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের নাম বাদ রেখে প্রার্থীর প্যানেল প্রস্তুত করে নৌকা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাগুরা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী রানা আমির ওসমান বলেন, ‘জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিরোধী দল ছিলো না। দলীয় প্রতীকও ছিলো না। বিরোধী দল না থাকায় আওয়ামী লীগের পক্ষে থেকে প্রার্থিতা উন্মুক্ত করা হয়। সে কারণে আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কখনো নৌকার বিরোধিতা করি না। সবসময় নৌকার পক্ষেই কাজ করি।’
স্থানীয় আ.লীগ সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই দুই ভাগে বিভক্ত মাগুরা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। গত জাতীয় সংসদ এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় অনেকটাই বেকাদায় পড়েন নৌকার মনোনীত প্রার্থী এবং সমর্থকরা। আর এই সকল বিদ্রোহীদের সরাসরি মদত দেন স্থানীয় এক সংসদ সদস্য।
স্থানীয় প্রভাবশালী ওই এমপির এমন পক্ষপাতিত্বে দলের ত্যাগী, পরিশ্রমী এবং বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় আন্দোলন-সংগ্রম করা নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
গত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল বর্তমানে চলমান রয়েছে জানিয়ে মাগুরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বলেন, ‘দলের দায়িত্বশীল কেউ যদি ভোটের মাঠে নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাহলে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। দলীয় বিদ্রোহীদের কারণে যে সকল কোন্দল সৃষ্টি হয়েছিল তা বর্তমানেও চলমান রয়েছে।’
প্রার্থী সূত্রে জানা যায়, প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে ফরম বিতরণের শুরু থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান পরিষ্কার থাকলেও বিপত্তি দেখা দিয়েছে দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচন ঘিরে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কঠোর নির্দেশ থাকার পরও দ্বিতীয় ধাপে দলীয় মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বেশ কজন বিদ্রোহী প্রার্থী।
তৃণমূলের নাম পাঠানোর মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বলছেন, বিদ্রোহীদের বিষয়ে দলীয় নির্দেশ থাকার পরও কীভাবে মনোনয়ন ফরম পাচ্ছেন। অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে বিদ্রোহ করার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তারা আমাদের কথা শুনে আশ্বস্ত করছেন এবং দলীয় মনোনয়ন তুলতে বলেছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন— যারা তথ্য গোপন করে দলীয় মনোনয়নপত্র তুলছেন, কোনোভাবেই এদের মনোনয়ন দেয়া হবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘বিদ্রোহীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত পরিষ্কার। কোনোভাবেই এদের মনোনয়ন দেয়া হবে না।’
আ.লীগ সূত্র জানায়, টানা ১২ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ক্ষমতার দীর্ঘ সময়েও দলের তৃণমূলের ইউনিটিগুলোতে কোন্দল নিরসন করতে পারেনি দলটি। তৃণমূল আওয়ামী লীগে যেনো দিন দিন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
আর এই সকল কোন্দলের মূল কারণ হচ্ছে ভোটের মাঠে দলীয় বিদ্রোহী ও প্রকাশ্যে এমপি-মন্ত্রীদের পক্ষপাতিত্ব। তৃণমূলের এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে চান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ জন্য তিনি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়ন দিচ্ছেন না। সভানেত্রীর নির্দেশনা থাকলেও দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনগুলোতে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী। আর এই সকল বিদ্রোহীর মনোনয়নপত্র পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন নিজ বলয়ের এমপি এবং কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতারা।
এছাড়াও দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বিদ্রোহীরা।
তারা সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়, গুলিস্তান কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বাসাবাড়িতে অবস্থান করছেন। নানা কৌশলে তুলে ধরছেন বিগত দিনে বিদ্রোহী করার কারণ।
বিদ্রোহীরা বলছেন, প্রকাশ্যে এমপি-মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের পক্ষপাতিত্ব, টাকার মাধ্যমে মনোনয়ন বাণিজ্য, প্রভাবশালীদের একক আধিপত্য ধরে রাখতে রাজনৈতিক অপকৌশল, যোগ্য ব্যক্তিকে নৌকার মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হওয়াসহ বেশ কয়েকটি কারণে ভোটের মাঠে বিদ্রোহী করেন তারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, ‘মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা এবং চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া, এক কথা নয়। বিদ্রোহীদের চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হয় কি-না, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগেরই কর্মী। তারা এখনো দলেই আছেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না। এটাই তাদের জন্য শাস্তি। এটা কার্যকর করা হচ্ছে। আগামীতে তাদের জন্য নতুন সিদ্ধান্তও আওয়ামী লীগ নিতে পারে। এটার জন্যও অপেক্ষা করতে হবে।’