ছোট্ট একটি গল্প দিয়েই শুরু করি। কয়েক বছর আগের ঘটনা। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলার কলেজ মাঠে বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলছিল। মেলা উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক। তো অতিথিদের খোশ গল্প চলছিল। এমন সময় একটি মন্তব্য করে বসেন কলেজের অধ্যক্ষ। জেলা প্রশাসককে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আমি তো চাকরিতে উনার সিনিয়র’। ব্যস এইটুকুই। এরপর প্রজাতন্ত্রের ওই দুই কর্মকর্তার মধ্যে এই নিয়ে কিছুক্ষণ বচসা হয়েছিল। অবস্থা বুঝে পক্ষ বিপক্ষও নিয়ে ছিলেন কেউ কেউ। ফলশ্রুতিতে ক’দিন পরেই একটি নতুন কলেজে বদলী হতে হয়েছিলো প্রবীণ এই অধ্যক্ষকে। চাকরি জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে শুধু একটা মন্তব্য করায় বাক্স প্যাটরা হাতে অধ্যক্ষকে চলে যেতে হয়েছিলো একটি নতুন কর্মস্থলে।
এই করোনার মধ্যেও নিজ ছাত্রের হাতে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন একজন শিক্ষক। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ওই কর্মকর্তা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একটি কলেজে আছেন। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শিক্ষা ক্যাডারদের অনেকেই তখন ফেইবুকের প্রোফাইল ছবিতে ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বিলোপ চাই’ ফ্রেম লাগিয়েছিলেন। ওই ঘটনার বিচারও তদন্তও দাবি করেছেন অনেকে। কিন্তু এসব যেন অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে। তার চেয়ে বেশী প্রশ্ন উঠছে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও তাদের মর্যাদা নিয়ে।
শিক্ষকতা মানেই যেন হতাশা
একটা সময় গ্রামে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। ডিগ্রী পাশ আর হাইস্কুলের মাস্টার হলে সম্মান আর কদরের মাত্রা আরও অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু এখন প্রাইমারি শিক্ষকতা যেন এক হতাশার নাম। নিজেদের সম্মান জনক কিছু দাবি-দাওয়া, সুযোগ-সুবিধা কিংবা উপযুক্ত একটি বেতন স্কেলের জন্যও তাদের রাস্তায় নামতে হয়। শিক্ষা কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই স্তরে শিক্ষক হিসেবে স্বেচ্ছায় কেউ কেউ আসতে চায় না। আমাদের প্রাইমারি শিক্ষকতা যেন অনেকটাই নাক ছিটকানো পেশা হয়ে গেছে।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বিলোপ চাই
প্রজাতন্ত্রের বেশিরভাগ শিক্ষা ক্যাডারই যেন এক ধরণের আত্মগ্লানিতে ভুগে। একই পরীক্ষা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে পাশ করে সুযোগ-সুবিধা আর সম্মানের বিষয়ে নিজের পুলিশ ক্যাডার কিংবা প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করা বন্ধুটির সাথে হিসেব মিলাতে পারে না। নানা প্রয়োজনে নিজের বন্ধুটির সাহায্য নিতে গিয়েও এক ধরণের গ্লানিতে ভুগে। তাছাড়া, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মী কিংবা নিজের উদ্ধত ছাত্রটির হাতে লাঞ্ছনার ভয় তো সবসময়ই থাকে। ফলে, হ্যালির ধুমকেতুর মতো নিজেদের সহকর্মী লাঞ্চিত হওয়া কিংবা সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তারা শুধু একটি দাবিই জানায়- আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বিলোপ চাই।
সামাজিক মর্যাদা
প্রত্যেকটা সমাজে একেকটা প্রজন্মের হাত ধরে কিছু পরিবর্তন আসে। কিন্তু এই পরিবর্তন কি না জানা যায় না- কিন্তু দেশে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ কবিতার ওই রকম সম্মানিত শিক্ষক পাওয়া এখন সত্যি দায়। যে কোন সভ্য দেশেই শিক্ষকদের সম্মান, সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থাকে সবচেয়ে বেশী। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের হাতেই শিশুরা সুনাগরিকতার শিক্ষা পেয়ে থাকে। সমাজের প্রতি তাদের অবদানও অনেক। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক সমাজ মানেই যেন নিগৃহীত। সেটা হোক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রাথমিক পর্যায়- সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের জীবনযাপনের গল্প অনেক করুণ। অর্থকে আদর্শিক মানদণ্ড করে তোলা এই সমাজে শিক্ষকতা যেন একটি গ্লানি বা টিকে থাকার নাম।